For Business Query please contact: export@handtouchbd.com Or Call: +880-1711304063

বুননে জীবন পরিবর্তন

শুরুতে তিনি কী করবেন এবং কীভাবে করবেন– সে সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন না। শুধু জানতেন, নিজের ব্যবসা শুরু করতে হবে। তিনি অর্থপূর্ণ কিছু করতে চেয়েছিলেন, শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য নয়। এটি ২০০২ সালের কথা। মোহাম্মদ আলী খান টেক্সটাইল শিল্পে কিছু করার স্বপ্ন সঙ্গী করে চা বাগানের ভালো বেতনের চাকরি ছেড়ে দেন। চটের ঝোলা কাঁধে নিয়ে রাজধানীতে এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তখন তিনি এমন জায়গার সন্ধান করছিলেন, যেখান থেকে কম দামে কিছু কাপড় কিনতে পারেন। তিনি অবশেষে এমন জায়গা খুঁজে পান যেখান থেকে কিছু ভালো মানের কাপড় সংগ্রহ করেন এবং তা বিভিন্ন শোরুম ও এনজিওতে বিক্রি করে কিছু টাকা লাভ করতে সক্ষম হন।

মোহাম্মদ আলীর ব্যবসা করার চিন্তাটা ছোটবেলার। জন্ম, বেড়ে ওঠা যশোরে। তাঁর বাবার আলু-পেঁয়াজের ব্যবসা ছিল। বছর দশেকের মোহাম্মদ আলী প্রায়ই যশোর বড় বাজারে তাঁর বাবার দোকানে বসতেন। তখন থেকেই মনের মধ্যে ব্যবসা করার চিন্তা বাসা বাঁধতে থাকে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায়, তিনি বুঝতে পারেন, আজীবন চাকরি না করলেও, চাকরি করেই তাঁকে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে, যা দিয়ে তিনি নিজের ব্যবসা শুরু করতে পারেন। স্নাতক শেষ করার পর মোহাম্মদ আলী বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে রেশম বিষয়ে পড়াশোনা করেন। পরে চীন থেকে সিল্কের ওপর মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছেন। তিনি জানান, ‘আমি ১৬ বছর সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চাকরি করেছি। আমি সিল্ক বোর্ডে কর্মজীবন শুরু করি। পরে ব্র্যাক, আরডিআরএস এবং বাংলাদেশ সিল্ক ফাউন্ডেশনের মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি।’

মাত্র ৪২ হাজার টাকা নিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ার চেষ্টা শুরু করেন মোহাম্মদ আলী। এটি ২০০২ সালের কথা। ততদিনে তিনি বিয়ে করেছেন। সংসারের দায়-দায়িত্ব রয়েছে তাঁর ওপর। তিনি জানতেন, তিন মাসের মধ্যে তাঁকে কিছু আয় করতেই হবে। তা না হলে তিনি টিকতে পারবেন না। তাই প্রথম পর্যায়ে তিনি পাইকারি কিনে পাইকারি বিক্রি করতেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে তিনি ফ্যাশন হাউসগুলো থেকে অর্ডার নিয়ে অন্য জায়গা থেকে তা তৈরি করে দিতেন। প্রথম বছরেই মোহাম্মদ আলী বুঝতে পেরেছিলেন যে, বস্ত্রের ব্যবসা সারা বছর ভালোভাবে চলতে পারে না, কারণ পোশাক প্রতিদিনের প্রয়োজন নয়। প্রায়ই একটি অলস সময় আসে। ব্যবসা চাঙ্গা করতে ঈদ বা অন্য কোনো উৎসবের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। মোহাম্মদ আলীকে সে অনুযায়ী তাঁর ব্যবসার পরিকল্পনা করতে হয়েছিল। এভাবে তিনি পাট কারিগরদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন এবং একই কাজ করেন।

তৃতীয় পর্যায়ে তিনি নিজের কারখানা গড়ে তোলেন। পঞ্চগড়ে চাকরি করার সময়ে মোহাম্মদ আলী দেখতে পান, সেখানে প্রচুর দরিদ্র মানুষ রয়েছে। তাদের বছরের একটা বড় সময়ে কাজ থাকে না। সেখানে যেমন তাঁর কাজ করার সুযোগ ছিল। তেমনি সেখানকার মানুষের জন্যও কিছু করার তাগিদ ছিল। এ থেকেই কারখানা বানানোর জন্য তিনি বেছে নেন পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জকে। এরপর হ্যান্ডিক্রাফট কারখানা দিয়েছেন মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে।

প্রায় আট বছর ধরে হ্যান্ড টাচে কাজ করছেন রেহানা আক্তার। ঢাকার আদাবরে প্রতিষ্ঠানটির শো-রুমের দায়িত্বে আছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘একটা পণ্য যখন হাতে বানানো হয়, তখন তার দাম একটু বেশি পড়ে। তাই সব শ্রেণির মানুষ এখান থেকে পণ্য কেনেন এমন নয়। নিম্ন আয়ের মানুষ তো সেই পরিমাণ টাকা দিয়ে কোনো পণ্য কিনতে চাইবে না। হ্যান্ড টাচে মূলত মধ্যবিত্ত, বিভিন্ন পেশাজীবী আসেন, যারা হাতে তৈরি পণ্য ব্যবহার করতে চান।’

স্থানীয় বাজারে ৯ বছরের অভিজ্ঞতার পর হ্যান্ড টাচ ২০১১ সালে রপ্তানি বাজারে প্রবেশ করে জাপানে পণ্য পাঠানোর মধ্য দিয়ে। শুরুতে স্কার্ফসহ কিছু টেক্সটাইলভিত্তিক পণ্য রপ্তানি করত প্রতিষ্ঠানটি। তবে মোহাম্মদ আলী দেখলেন রপ্তানি বাজারে আরও ভালো কিছু করার সুযোগ রয়েছে। নেদারল্যান্ডস সরকারের সিবিআই নামে একটি প্রকল্পের অধীনে ২০১৪ সাল থেকে তিন বছর ফ্রান্সে মেলা করার সুযোগ পায় হ্যান্ড টাচ। এটি ছিল প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানির ক্ষেত্রে একটি বাঁক পরিবর্তন। মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘মেলাটি টেক্সটাইলভিত্তিক হলেও সেখানে অল্প আকারে ঝুড়ি নিয়ে গিয়েছি। আমি দেখলাম, উৎপাদন খরচ, মান, ডিজাইন মিলিয়ে বাংলাদেশ থেকে হ্যান্ডলুম পণ্য রপ্তানি করা খুব কঠিন।’ অপরদিকে হোগলা, বেত, কাইসা ঘাস, পাট এবং রিসাইকেল দড়ি থেকে বানানো ঝুড়ির তার বেশ চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি জাপান, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, যুক্তরাজ্য ও সুইডেনে তাঁত কাপড় এবং হাতে তৈরি টেক্সটাইল পণ্য, বিশেষত বেত, বাঁশ, পরিবেশবান্ধব পণ্য রপ্তানি করছে। গত বছর জার্মানিতে মেলায় অংশ নিয়ে হ্যান্ড টাচ সৌদি আরব ও উরুগুয়ের গ্রাহক পায়। তারা বেশ বড় অঙ্কের পণ্য নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি থেকে। মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমাদের সক্ষমতার তুলনায় আমরা কম কাজ পাই। প্রতিবছর আমরা ৩ থেকে ৬ লাখ ডলারের কাজ পাই। তবে আমাদের ক্ষমতা আছে ১০ লাখ ডলারের পণ্য বিদেশে রপ্তানি করার।’

রপ্তানিমুখী চিন্তার বিষয়ে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে আমাদের মূল খরচটা চলে যায় খাওয়া, পরা, শিক্ষা, চিকিৎসার দিকে। ফলে বাঁশ-বেতের মতো মাটিতে মিশে যাবে, এমন পণ্যের বদলে আমরা খোঁজ করি প্লাস্টিক-পলিথিনের মতো টেকসই পণ্যের। অপরদিকে, ইউরোপ বা জাপানের লোকজন মাটির সঙ্গে মিশবে, এমন পণ্যের খোঁজ করে। আর্থসামাজিক কারণেই আমাদের সঙ্গে তাদের চিন্তার জায়গাটা ভিন্ন। আমাদের দেশের ধনিক শ্রেণির লোকজন হয়তো তা ব্যবহার করতে পারে বা করেও। কিন্তু দেশে এমন পণ্যের বাজারটা নগণ্য। পরিবেশের প্রতি সচেতনতা বাড়লে হয়তো এখানেও এসব পণ্যের একটা বাজার গড়ে উঠতে পারে।’

প্রতিবেদন সূত্র - সমকাল